ইসলাম ও বৈরাগ্যবাদ-(০১-০৪)

লিখেছেন লিখেছেন Saidul Karim ১০ ডিসেম্বর, ২০১৫, ০৮:৫৩:৫৭ সকাল

[০১]

ইসলাম সম্পর্কে যথার্থ হল-"Islam is not only a religion but also a complete code of life".অর্থাৎ, ইসলাম শুধু একটি ধর্ম নয় এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থাও।এতে যেমন যুদ্ধের আহ্বান রয়েছ তেমনি রয়েছে সন্ধির।যেমনি এতে বিবাহ বিচ্ছেদের নীতি স্থান পেয়েছে তেমনি বিবাহ নবায়নের পদ্ধতিও আছে। ইসলাম শুধু সুদের বিধান দিয়ে ক্ষান্ত হননি বরং; ব্যবসার সুস্পষ্ট রুপরেখা পুঙ্খানু পুঙ্খু বর্ণনা করেছেন। কিন্তু অন্য সব মতবাদ বা ধর্মে এসব অনুপস্থিত।তাই একজন মুসলমানের জন্য রাখাল হওয়া যেমন সুন্নাত তেমনি সুন্নাত হলো রাষ্ট্র নায়ক হওয়া।একজন মুসলমানের জন্য মসজীদে নামাজ পড়া যেমন সুন্নাত তেমনি মসজীদে বসে দেশ পরিচালিনাও সুন্নাত।তবে আজ মুসলিমদের একটি বিরাট অংশ "মসজীদের ভেতর দুনিয়াবী কথা বলা নিষেধ" লিখা সম্বলিত ফেস্টুন টাঙ্গিয়ে দেয়।যা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।ভুল বুঝবেন না,মসজীদে বসে যদি দুনিয়াবি কথা বলা নিষেধ হয় তবে,নামায শেষে -"রাব্বানা আতিনা ফিদ-দুনিয়া তথা হে আমার রব! আমাকে দুনিয়াতে উত্তম বস্তু দাও" বলে দু'আ করা হয় কোন যুক্তিতে? অথচ নামাযের অন্যতম একটি গুরুত্ববহ উদ্দেশ্য হল-মসজীদ কেন্দ্রীক জীবন আর সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। আল্লাহ বলেছেন-"তোমরা নামায সমাপ্ত করে আল্লাহর অনুগ্রহ তথা জীবিকা নির্বাহের জন্য ছড়িয়ে পড়"।(সুরা জুমা,আয়াত-১০)

আজ আমরা জীবিকা নির্বাহ না করে নামাযের জন্য মসজীদে বাস করি।অর্থাৎ নামায পড়ি কিন্তু জীবিকা নির্বাহের জন্য ছড়িয়ে পড়িনা। কোরআন-হাদীস বলে একটি আমরা করি অন্যটি।আমরা এখন বনী ঈস্রাইলের চেয়ে কম নয়।মানুষ সৃষ্টি সম্পর্কে আল্লাহর উদ্দেশ্য হল; "আমি জীন ও মানুষকে একমাত্র আমার দাসত্বের জন্য সৃষ্টি করেছি"।(সুরা আয-যারিয়াত,৫৬)আর এ দাসত্ব তথা গোলামী দু'ধরণের।অর্থাৎ,দু'ভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে হবে। যথা-

১.স্রষ্টা সম্পর্কীত: ঈমান,নামায,রোযা,হজ্জ্ব,যাকাত ইত্যাদি।

২.সৃষ্টি সম্পর্কীত: বিবাহ,ব্যবসা,পরিবার-পরিজনের ভরণ-পোষন,সন্তান লালন,সমাজ শাষন,রাষ্ট্র পরিচালনা ইত্যাদি।তাই আল্লাহ তায়ালা নামায,রোজা,হজ্জ্ব ও যাকাত যেমন ফরয তথা অপরিহার্য পালনীয় সাব্যস্ত করেছেন তেমনি স্ত্রীর ভরণ-পোষণ,সন্তান। লালন,প্রতিবেশীকে সাহায্য করাও ফরয হিসেবে গণ্য করেছেন।যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেছেন; "তাদের কে যখন ক্ষমতা দান করা হয় তারা নামায কয়েম করে,যাকাত দেয়,সৎ কাজে আদেশ দেয় ও অসৎ কাজেনিষেধ করে"।(সুরা হাজ্জ,৪১)

তিনি আরো বলেছেন; " নারীর প্রতি ভালবাসা, সন্তান-সন্ততি,সোনা-রুপার স্তুপ,পছন্দসই ঘোড়া(যানবাহন),গৃহপালিত জন্তু ও জমীনের ফসল মানুষের জন্য আকর্ষণীয় করা করা হয়েছে"।(সুরা আলে ইমরান,১৪)

লক্ষ্য করুন,উপরিউক্ত প্রথম আয়াতে রাষ্ট্র ক্ষমতার সাথে নামায,যাকাতকে সংযুক্ত করা হয়েছে আবার দ্বিতীয় আয়াতে আলাদাভাবে নিতান্ত দুনিয়ার ভোগ্য সামগ্রী সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।আর এভাবে আল্লাহ এ দু'টি বিষয়কে পাশাপাশি ও ভিন্নভাবে উল্লেখ করে এদের মাঝে সমন্বয় সাধন করেছেন।তাই কেউ যদি শুধু 'স্রষ্টা সম্পর্কিত' বন্দেগীই মুক্তির একমাত্র উপায় মনে করে তবে তারা ক্রমান্বয়ে বৈরাগ্যবাদের দিকে ধাবিত হয় আর যারা শুধু 'সৃষ্টি সম্পর্কিত' বন্দেগীই করে তারা শেষে বস্তুবাদী হয়ে আল্লাহকে ভুলে যায়।

আমরা এখন ইসলাম বলতে শুধু নামায রোযাকেই বুঝি।কিন্তু,শুধু নামায রোযারই নাম ইবাদত নয়।ইমাম গাযযালী স্বীয় গ্রন্থ,আরাবাঈন-এ দশ প্রকার ইবাদতের কথা লিখেছেন।যথা-১.নামায ২.যাকাত ৩.রোযা ৪.কোরআন তেলাওয়াত ৫. সর্বাবস্থায় আল্লাহর স্মরণ ৬.হালাল উপার্জনের চেষ্টা করা ৭.প্রতিবেশীর হক ও সাথিদের প্রাপ্য পরিশোধ করা ৮.সৎ কাজের আদেশ ৯.অসৎ কাজের নিষেধ করা। ১০.রসূলের সুন্নাত পালন করা।

উপরিউক্ত দশ প্রকার ইবাদতের প্রতি খেয়াল করলে বুঝা যায় দশ প্রকারের কোনটিই সমাজ ও সামাজিকতার বহির্ভূত নয়।তাই সমাজ ও পরিবার কে বাদ দিয়ে জন-মানবহীন জঙ্গলে কখনো ইসলামের কার্যকারিতা উপলব্দি হতে পারেনা।কবর,হাশর,পুলসিরাত তথা পরকালের পুরষ্কার এবং তিরষ্কার নির্ভর করে মানুষের কর্মের মানদন্ড নিয়ে।সূতরাং মানুষের কর্ম তালিকা যদি কার্য শূন্য হয় পুরষ্কার-তিরষ্কার হবে কিসের ভিক্তিতে? প্রতিদান দিবসে আল্লাহর কাছে জবাদিহি করতে হবে তাই এর ভয় থাকবে স্বাভাবিক।এটি যদি আমাদের জীবন নির্বাহ থেকে দূরে সরিয়ে দেয় তাকে কখনো আল্লাহভীতি বলা চলে না বরং এটা তখন সন্ন্যাসব্রত হয়ে যায়;যার কোন ভিক্তি ইসলামে নাই।আল্লাহর যিকর তাই যা মানুষ কে অননুমোদিত কাজ থেকে বিরত রাখে।আপনি যখন ব্যবসা করবেন তখন পরকালে জাবাবদিহির ভয়ে ওজনে কম না দেওয়া হলো যিকর। আপনি যখন শিক্ষক তখন নিজ সন্তান কে ফার্স্ট করার মানসিকতা নিয়ে পরের সন্তান কে কম নম্বর না দিয়ে মেধার সঠিক মূল্যায়ন করা যিকর।আপনি যখন ব্যরিস্টার তখন নিজের মক্কেল কে জিতানোর জন্য মিথ্যার আশ্রয় না নেওয়া যিকর।আর এটি না করে যদি 'হাজার দানা বিশিষ্ট্য তাসবীহ' নিয়ে আল্লাহু আল্লাহু জপ করেন এবং বাপ-দাদার সিলসিলা জারি রাখেন তবে তা কখনো ইসলাম নয় আবার যিকরও নয়।হযরত সায়ীদ ইবনে জুবাইর (র) 'যিকরুল্লাহ'র তফসীর প্রসঙ্গে বলেছেন যে,যিকিরের অর্থই হচ্ছে আনুগত্যএবংনির্দেশ মান্য করা।তাঁর বক্তব্য হচ্ছে-"যে ব্যক্তি আল্লাহর নির্দেশের আনুগত্য করেনা,সে আল্লাহর যিকরই করেনা; প্রকাশ্যে যত বেশী নামায এবং তাসবীহই সে পাঠ করুক না কেন।"(মাআরেফুল ক্বুরআন,পৃ:৭৮)

[০২]

হিন্দু ধর্মে ধর্মীয় কার্যাবলী সম্পন্ন করেন পুরোহিতগণ।দেখা যায় পুরোহিত যখন মন্ত্র পাঠ করেন তখন পূজারীরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন।আবার ম্যাজিয়ান এবং সেবিয়ান সম্প্রদায়দের ধর্মে একমাত্র পুরোহিতগণই মন্ত্র পাঠ করতে পারেন।সাধারণ পূজারীরা দর্শক,তারা পূজার কোনো কাজে অংশগ্রহণ করতে পারেনা। আধ্যাত্মিক ক্ষমতার অধিকারী পুরোহিতগণই পূজাপাঠের একচ্ছত্র দাবীদার।তাদেরকেধর্মীয় মন্ত্রী তথা minister of religion বলা হয়।হিব্রু ধর্মে পুরোহিতদের কর প্রদানের প্রচলন ছিল এবং স্রষ্টার আশীর্বাদের জন্য পুরোহিতদের মাধ্যমে পূজা করতে হত।বৌদ্ধধর্মে পুরোহিতই ধর্মীয় যাবতীয় কাজের আঞ্জাম দেন।তিনি দুনিয়ার কোনো লেনদেনের সাথে সংশ্লিষ্ট নন।তাঁর সংসার বলতে কেবল প্রেগুডাকে বুঝানো হয়।কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (সHappyআনীত বিধান ইসলামে পুরোহিততন্ত্রের কোনো স্থান নেই।কোনো বিশেষ ধর্মীয় গোষ্ঠী বা ব্যক্তির আধ্যাত্মিক জ্ঞানের কোনো একক অধিকার নেই।আল্লাহ ও বান্দাহর মধ্যে কারো মধ্যস্থতার প্রয়োজন নেই।বরং এটি নিন্দানীয়।প্রত্যেক ব্যক্তি কোনো পুরোহিত,পীর বা মধ্যস্থতাকারী ব্যতীত আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করতে পারে।ইসলামে কোনো বলি প্রথা নাই,কোনো আনুষ্ঠানিকতা নাই,আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য মসজীদে গরু,সিন্নি দেওয়ার প্রয়োজন নেই,এগুলো বিশেষ সুবিধাভোগীদের সৃষ্টি।অনুতপ্ত বান্দাহ যেকোনো সময় যেকোনো দিনে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের চেষ্টা করতে পারে।ইসলামে প্রত্যেক মানুষ তার নিজের পুরোহিত।এতে কোনো vai media এর প্রয়োজন নেই। ইসলামে ইবাদতের ক্ষেত্রে ব্যক্তিই প্রধান।এ ক্ষেত্রে হিন্দু,বৌদ্ধ ও খ্রস্টানগণ পুরোহিতদের ওপরনির্ভরশীল।আর আধুনিক যুগের মুসলিমগণ ধর্মের পূর্ণ আদর্শ নীতি অনুসরণ না করে বাহ্যিক আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে ব্যস্ত।জনৈক ইংরেজ লেখকের মতে,"হিব্রুগণ Pentateuch কে পরিহার করে যেমন তালমুদকে গ্রহণ করে তেমনি মুসলিমরা পবিত্র কুরআনকে পরিত্যাগ করে তাদের ঈমামের বাণী ও নির্দেশনাকে প্রাধান্য দেয়"।

ইসলামে যে কেউ তাক্বওয়ার ভিত্তিতে ইমাম হতে পারে,নেতৃত্ব দিতে পারে।এতে নেই কোনো ভেদাভেদ।আলেমের সন্তান হলে আলেম হবে কুরআন-হাদীস পড়তে পারবে এমন নীতি ইসলামের নয়।ইসলামে আত্মার পরিশুদ্ধির জন্য পরিবার ছাড়তে হয়না।নবী করিম (সHappy দৈনিক পাঁচবার সালাত আদায়ের মাধ্যমে মানবাত্মার সাথে পরমাত্মার সুযোগ করে দেন।যেমন আল্লাহর বাণী-"নিশ্চয় সালাত যাবতীয় মন্দ ও নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত রাখে"।(সুরা আনকাবুত,আয়াত-৪৫)

মাজার কিংবা কোনো পীর-ফকিরের তাসবীহ ঈমান বৃদ্ধি করতে পারেনা।ঈমান বৃদ্ধি করতে পারে কেবল কুরআন।আল্লাহ তায়ালা বলেন-"নিশ্চয় মুমিন তারা,যাদের আল্লাহর স্মরণ হলে হৃদয় কেঁপে উঠে এবং তাদের সামনে তাঁর আয়াত (কুরআন) তেলাওয়াত হলে তাদের ঈমান বেড়ে যায়"।(সুরা আনফাল,আয়াত-২)

ইসলাম একটি সার্বজনীন ও কল্যাণকামী জীবন ব্যবস্থা।উদাহরণসরুপ বলা যায়,নিজ দেশ ও আদর্শ বিরুধীদের সাথে যুদ্ধ হলে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে মুসলিমরা মদ-জোয়ার আশ্রয় নিতে পারবেনা।কেননা,ইসলামী দর্শন মতে তা শুধু মুসলিমদের হানি করেনা পুরো মানব জাতীর জন্য অনিষ্টকর।ইসলামী আদালতের মানদন্ড হলো-ধর্ম,বর্ণ সকলে ন্যায় বিচার পাওয়ার হকদার।হোক না সে ইহুদী,খ্রীষ্টান,হিন্দু কিংবা বৌদ্ধ।যেমন আল্লাহর বাণী-"তোমরা যখন মানুষের মাঝে বিচার-ফয়সালাকর,তখন ন্যায়ের সাথে করবে"।(সূরা নিসা,আয়াত-৫৮)

তেমনি ইসলামী বিধান পালনের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য।যেমন:দুর্বল,অসুস্থ,ভ্রমনরত ব্যক্তি,শিশু-বৃদ্ধদের জন্য রোজা পালনের ব্যাপারে শিথিলতা রয়েছে। সালাতের ক্ষেত্রেও দেখা যায়,সফররত ব্যক্তির জন্য চার রাকাত বিশিষ্ট ফরয সালাতকে দু'রাকাত করা হয়েছে।আর কেউ যদি অসুস্থতার কারণে সালাত দাঁড়িয়ে আদায় করতে না পারে তার জন্য বসে সালাত আদায়ের নিয়মও আছে।অর্থাৎ ইসলাম এমন একটি মানবিক ধর্ম ও জীবন ব্যবস্থা যাতে কোনো কুসংস্কার কিংবা ভাওতাবাজী নেই।ইসলাম ধর্মের প্রাধান বৈশিষ্ট হচ্ছে,বাস্তবতার আলোকে সঙ্গতিপূর্ণ যুক্তি বা সিদ্ধান্ত এবং উদারতার ওপর ভিত্তি করে নৈতিক অনুশাসনগুলো সমন্বয় করা।ইসলাম এমন একটি ধর্ম যা বিশ্বভ্রাতৃত্ব জাগ্রত করে এবং ইবাদত বন্দেগী দ্বারা আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করার প্রেরণা দেয়।তাই ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিতে ধর্ম নিছক কতগুলো বিধান,অনুশাসন,নৈতিক কোড নয়।ধর্ম পুরোহিতদেরদ্বারা প্রচারিত কোনো মূল্যবোধ নয়।ধর্ম মানসিক চিন্তার গৌরবমন্ডিত ফর্মূলা নয়।ধর্ম জীবনধারা নিয়ন্ত্রণের উপায়।

কিন্তু,চলমান সময়ে ধর্ম জীবনধারা নিয়ন্ত্রণের উপায় নয় বরং জীবনধারা থেকে বের করার উপায় হিসেবে গ্রহণ করছে অনেকে।যা হিন্দু,বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্ম থেকে মুসলিম সমাজে প্রবেশ করেছে।উদাহরণ সরুপ বলা যায়,খ্রিস্টানদের মধ্যে এমন ধারণা রয়েছে যে,বিবাহিত পুরুষ অপেক্ষা অবিবাহিত পুরুষের সামাজিক মর্যাদা অনেক ওপরে।আর আমাদের জ্ঞাত যে,বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ সকলেই চিরকুমার।তারা মনে করে যে,পরিবার এবং আত্মীয়-স্বজনের সাথে সম্পর্ক ছেদ না করলে মোক্ষ লাভ করা যায়না।আর নি:সঙ্গভাবে তপস্যা না করলে মোক্ষ লাভ অসম্ভব।অথচ নবী করীম (স) এর জীবনী এটি অসারত্বই প্রমাণ করে।কেননা কুমারত্ব কোনো মানুষকে সামাজিক মর্যাদা দিতে পারেনা,কারণ সে সমাজ ও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন,তার সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকেনা।আর যার ওপর সমাজের দায়বদ্ধতা থাকেনা সে কিভাবে সমাজ সংশোধন করবে? মুসলিমরা কুমার থাকেনা ঠিক।কিন্তু অনেকে জীবন যাত্রা সম্পর্কে নিষ্ক্রিয় ভাব লালন করছে।এমনকি ঈদুল ফিতর,ঈদুল আযহা-সহ অন্যান্য সামাজীক ও রাষ্ট্রীয় অন্দোলনে অংশ না নিয়ে মসজীদেই অবস্থান করে।অথচ মসজীদে বসে রাজনৈতিক নিপীড়ন,জালিমের নগ্ন হস্তক্ষেপ যে মোকাবেলা করা যায়না তা হাজার বছরের ইতিহাস থেকে প্রমাণিত।এখানে স্পেনের কথা বলা যায়; যখন মুসলিমরা নিরাপদ অশ্রয়ের আশায় রাজনৈতিক,বুদ্ধিবৃত্তিক ও নেতৃত্বের ময়দান ছেড়ে কপট ফার্দিনান্দের প্রতিশ্রুতিতে মসজীদে আশ্রয় নিয়েছিলো তখন থেকে আজ অবধি তাদের কপালে লাঞ্ছনাই জুটছে।তাই,চাই মুসলিমদের রাজনৈতিক,পারিবারিক,সামাজিক ও মসজীদের অবস্থান যেন হয় সমান ও সমান্তরাল।

[0৩]

বর্তমানে মুসলিম উম্মাহর চরম দুর্দশা দেখে সাধারণ ব্যক্তিদের পাশাপাশি অনেক শিক্ষিত ব্যক্তিও বলেন,ইসলামের রীতি-নীতি দিয়ে আধুনিক সমাজ পরিচালনা সম্ভব নয়!

২০১২ সালে দৈবক্রমে সাক্ষাৎ হয় আমাদের পার্শ্ববর্তী ইউনিয়নের একজন প্রফেসরের সাথে।তিনি মাদ্রাসা থেকে আলীম পাশ।অর্থাৎ শিক্ষা জীবনের বারোটি বছর কাটিয়েছেন কুরান-হাদীসের সংস্পর্শে।প্রসঙ্গক্রমে কথা হচ্ছিল ইসলামী রাজনীতি ও সমাজ বিনির্মাণ নিয়ে।তিনি খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে আমাদের বললেন,পৃথিবীতে আর কোনোদিন ইসলাম প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।তিনি যুক্তি হিসেবে দেখালেন,হযরত উমর,উসমান ও আলী (র) এর নিহতের ঘটনা।তার দৃষ্টিতে এগুলো কোনো শাসনই না! তিনি বেমালুম ভুলে গেলেন,খুলাফায়ে রাশেদিন,তাবয়ীনদের সোনালী সাতশত বছর এবং সভ্যতায় মুসলিমদের অবদানের কথা।তারপর বললেন,ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠায় রত তরুণদের কথা।তারা যে শার্ট-প্যান্ট পড়ে এবং দাঁড়ি ছোট রাখে তা তার ভালো লাগেনা। আমি তাকেবললাম,আপনার যেগুলো ভালো লাগেনা সেগুলো আপনি কেন করেন।অর্থাৎ আপনারও তো দাঁড়ি নেই এবং কেন শার্ট-প্যান্ট পড়েন? এগুলো যদি ইসলামে হারাম হয় মুসলিম হিসেবে আপনার কি উচিত নয় এর সংস্কার কিংবা বন্ধের! তারপর বললাম,আপনি বাম রাজনীতি করেন এবং জানেন ইসলামী রাজনীতি করা ফরয।আপনি ফরয ত্যাগ করে যেভাবে নফল নিয়ে টানাটানি করছেন-এতে আপনার সমালোচনা করার যোগ্যাতার ভিক্তি কোথায়! তিনি আর কোনো জবাব দেননি।তাকে এই কথাগুলো বলতে আমার সংকোচ লাগছিল কারণ,আমি তখন দশম শ্রেনির ছাত্র।তার সাথে সেদিন কথা বলে খুব খারাপ লাগছিলো।মনকে বোঝাতে পারতাম যদি তিনি একজন সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তি হতেন।এখনো এটি মনে পড়লে আমার প্রশ্ন জাগে,কেন এমন হলো? গলদ কোথায়? তিনি মাদ্রাসায় কী পড়েছিলেন।সময় এসেছে মুসলমানদের পশ্চাদপদতার কারণ ভেবে দেখার এবং এ থেকে উত্তরণের উপায় খোঁজার।আজ থেকে প্রায় শত বছর আগে এটি উপলব্দি করে স্যার সৈয়দ আমীর আলী তাঁর দ্য স্পিরিট আব ইসলাম গ্রন্থে লিখেছেন-"আজকের মুসলিম বিশ্বের অধ:পতনের কারণ হচ্ছে-ইসলামের মূল আদর্শ থেকে বিচ্যুতি,মুক্ত চিন্তার প্রয়োগের অভাব,মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বিভেদ এবং আধুনিক বিশ্বের(বিংশ শতাব্দী) যুগোপযোগী চিন্তাধারার অভাব"।

সম্প্রতিকালে মুসলিমদের মাঝে মুক্তচিন্তা চর্চা দারুণভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।তাই আমাদের মস্তিষ্কে সংকীর্ণতা বাসা বাঁধছে।এর অর্থ এই নয় যে,মুক্তচিন্তার নামে নাস্তিকতা,স্বাধীনতার নামে স্বেচ্ছাচারিতা।রাসূল (স) এর আদর্শ,মহাগ্রন্থআল কুরআনের দিকনির্দেশনার পরিবর্তে পীর সাহেব,খতীব সাহেব,মুরব্বী মহোদয়,ইমাম হুজুর যা বলেন তা ইসলাম আর এটিই ইসলামী জীবনাদর্শের একমাত্র ব্যাখ্যা হিসেবে গ্রহণ করা হচ্ছে ।মনে করি নিজের গ্রামের খতীব সাহেব যা বলবেন তা পরীক্ষিত সত্য অবশিষ্টগুলো ভ্রান্ত।

৭৫০ খ্রীস্টাব্দ থেকে ১৩৫০ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত মুসলিমরা যে জ্ঞান চর্চাকে ইসলামী সমাজের জন্য অপরিহার্য মনে করত আজ শত শত বছর পরে এসে সেগুলোকে ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক মনে করে মুসলিমরা গবেষণা ও মুক্ত চিন্তা থেকে দূরে থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞানে একচেটিয়া নেতৃত্বের আসনের সাথে হারিয়েছে বিশ্বের প্রতিপত্তিও।

১১শ খ্রীস্টাব্দ থেকে ১৩৫০ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত ইউরোপ মুসলিমের অংশীদারিত্বে বিজ্ঞান চর্চা করে।১৩৫০ খ্রীস্টাব্দ থেকে ইউরোপ একক দখলে নেয় এই আসন।বলা যায়,চতুর্দশ শতাব্দি থেকে ইউরোপে বিজ্ঞানের সোনালি যুগ শুরু হয়।তবু চতুর্দশ থেকে সপ্তদশ শতাব্দি পর্যন্ত শুধুমাত্র বিজ্ঞান ও স্বাধীন জ্ঞানচর্চার অপরাধে গির্জার যাজকতন্ত্র পঁয়ত্রিশ হাজার লোককে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে।আরো পরিষ্কার করে বলতে গেলে,"ইউরোপ বিজ্ঞানের স্বর্ণ যুগে এসেই বিজ্ঞান চর্চাকারীদের পুড়িয়েছে।" যার ফলশ্রুতিতে জনসাধারণ ধর্মনিরপেক্ষ হতে বাধ্য হয়।রাষ্ট্র থেকে বিদায় নেই ধর্ম।তারা মনে করে,ধর্ম ও তৎসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি শুধু মানুষ পুড়াতে জানে কল্যাণকর কিছু এতে অনুপস্থিত।

যখন খ্রীষ্টান পরোহিতগণ বিজ্ঞানীদের ধর্মদ্রোহিতার অপরাধে আগুনে পড়িয়ে হত্যা করছিলেন তখন বিশ্বে মুসলিমদের নেতৃত্ব না থাকায় তারা কোনো অবদান রাখতে পারেনি।আর এর শত শত বছর আগে চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক ইবনে সিনা (রহ) পাঁচ লক্ষাধিক পৃষ্ঠা সমৃদ্ধ"আল-কানুন" রচনা করে সভ্যতাকে সমৃদ্ধ করেছেন।রসায়ন শাস্ত্রের জনক জাবের ইবনে হাইয়ান (রহ) আবিষ্কার করছেন সাইট্রিক এসিড ও এসিডে স্বর্ণ গলানোর ফর্মুলা।অথচ এগুলো তখন ইসলাম বিরোধি গবেষণা হিসেবে চিহ্নিত হয়নি। কিন্তু আজ সে সময়ের শত শত বছর পরে এসে মুসলিমরা মোবাইল কিংবা কম্পিউটারে ভিডিও বা অডিও তেলাওয়াত শুনলে সওয়াব হবেনা মর্মে ফতওয়া দেন।যা অবর্ণনীয় কষ্টের কারণ। অথচ এ সম্পর্কে ইসলামের বিধান হলো-যদি মোবাইলে কিংবা কম্পিউটারে অশ্লীল ফিল্ম আর গান শুনলে গোনাহ হয় তবে কুরআন তেলাওয়াত করলে বা শুনলেও সওয়াব হবে।টেলিভিশন,সিডি,ডিবিডি ও ইন্টারনট ব্যবহারের উদ্দেশ্যের উপর নির্ভর করে এটি ব্যবহার করা হারাম না হালাল।তাই গড়পড়তা সকল মিডিয়াকে হারাম বলা যায় না।

এছাড়াও ইসলামে এমন কতগুলো বিষয় আছে যেগুলোর ব্যবহার ও পদ্ধতির ওপরই হালাল বা হারাম হাওয়া নির্ভর করে।যেমন-নাটক-ফিল্ম, টেলিভিশন,ইন্টারনেট,টেস্টিউবে সন্তান জন্ম দান ইত্যাদি।

পাশাপাশি কিছু মুসলিম মুক্তচিন্তার বিষয়টিকে 'ইসলামে একবিংশ শতাব্দীর নতুন সংযোজন' হিসেবে কটাক্ষ করে এড়িয়ে যাচ্ছে। এটি আবিষ্কৃত কোনো বিষয় নয় বরং এটি কোরআন হাদীস দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি অধিকার ।এ প্রসঙ্গ একটি হাদীস স্মরণীয়-"রাসূল (স) যখন মুয়াজ (র) কে ইয়েমেনের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দিলেন তখন তাকে জিজ্ঞাসা করলেন যে,কিভাবে তিনি শাসনকার্য পরিচালনা করবেন।মুয়াজ বললেন,পবিত্র কুরআনের আলোকে। নবীজী আবার জিজ্ঞাসা করলেন,তুমি যদি তাতে কোনো নির্দেশনা না পাও,তাহলে? মুয়াজ উত্তর দিলেন, তাহলে সুন্নাহ দ্বারা।নবীজী আবার জিজ্ঞাসা করলেন,যদি তাতে কোনো নির্দেশনা না পাও,তাহলে? মুয়াজ বললেন,তখন আমি আমার বিবেক-বিচার বুদ্ধি দিয়ে সমস্যার সমাধান করব।"

ইসলাম এমন ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠত নয় যাতে শুধু বয়:বৃদ্ধ বিজ্ঞ জনেরা সিদ্ধান্ত দিতে পারে।ইসলাম ইনসাফ ও অত্মত্যাগের ভিত্তিতে নবীন-প্রবীন সকলের মতামত দেওয়ার অধিকার নিশ্চিত করে।ইসলাম অন্ধ অনুগত্য যেমন স্বীকার করেনা তেমনি ব্যক্তির পরিবর্তনের কারণে আনুগত্যের পরিবর্তনও সহ্য করেনা।ইসলাম জীবনের সব ক্ষেত্রে পরামর্শপূর্বক কাজ শুরু করার নির্দেশ দেয়।

হযরত উমর (রHappy এর শাসনামলে নবীনেরা প্রবীনদের সামনে কিছু বলতে সংকোচবোধ করলে তিনি নবীনদের উৎসাহ দিয়ে বলতেন,জ্ঞান বয়স অনুপাতে পরিমাপ করা যায় না। বর্তমানে মুসলিমদের মাঝে এটি চরমভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে।মানুষের চিন্তার পরিধিকে হত্যা করে কবু অগ্রসর হওয়ার প্রমাণ জগতের ইতিহাসে নেই।ইসলামের ইতিহাসেও তা অনুপস্থিত।

মুসলিমদের ঈমান এমন স্তরে পৌছেছে যে,ইংরেজী পড়লে টেলিভিশন দেখলে ঈমান চলে যায়।নাটক,সিনেমা, সুর মুসলিমরা তৈরী করার পরিবর্তে তারা এর ঘোর বিরোধী।কিন্তু,এগুলোর বিকল্প না দিয়ে এর ব্যবহার থেকে মানুষকে ধর্মের কোড দিয়ে জাহান্নামের ভয় দেখিয়ে কখনো বিরত রাখা সম্ভব নয়।আমাদের ভুললে চলবেনা,শিক্ষক যা পারেনা নাটক-সিনেমা তা পারে।নাটক-সিনেমা কাউকে কিছু গ্রহণ বা বর্জনে বাধ্যকরেনা কিন্তু ক্রমান্বয়ে সিনেমায় প্রদর্শিত দৃশ্যের মত নিজেকে দেখার মানসিকতা সৃষ্টি করে।যার ফলে নাটক-সিনেমার প্রভাবে সমাজে এককালে যা প্রচলিত ছিলনা তার প্রচলন হয়।তাই এগুলো নিরবে মানুষের মনে প্রতিক্রিয়াশীল।

এর একটি বাস্তব উদাহরণ ভারতীয় সিনেমা।যার শুরুতে দেখা যায়,বিভিন্ন দেব দেবী এবং ছবির কাহিনীতেও নানান প্রেক্ষাপটে পূজার দৃশ্য।যা অবলোকন করে অবচেতন মন পূজার নিয়ম এবং দেব-দেবীর নাম শিখে ফেলে।যদি এর বিপরীত কোনো ইসলামীক মনা ব্যক্তি এই সিনেমা-নাটক তৈরী করতেন তাহলে সিনেমার শুরুতে দেখা যেত 'পবিত্র কাবা',মদীনা কিংবা নবী-রাসূলদের স্মৃতি বিজড়িত স্থান।কাহিনির নানান মোড়ে উচ্চারিত হত কুরআনের আয়াত ও নামাযের নিয়ম।অনিচ্ছা সত্ত্বেও মানুষের মন ইসলামের বাস্তব সৌন্দর্য উপভোগের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠত।আবার প্রত্যেক সিনেমায় কুরআন তিলাওয়াত হতে হবে এমনো নয়।সমাজে চলমান বা ঘটমান নানান সমস্যা ও তার ইসলামী ভাবধারার সমাধান নিয়েও হতে নাটক সিনেমা হতে পারে।

আমরা একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে দেখছি,বিশেষ করে আমেরিকা যখন ইসলাম ফোবিয়াই ভুগছিল এবং বিশ্বব্যাপী ইসলামী পূণজাগরণের সম্ভাবনা রুখতে মুসলিমদের কে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করা দরকার হলে তখনই আমেরিকা বিভিন্ন মুসলিম দেশে তথা বিশ্বব্যাপী জঙ্গী,আলকায়েদা নাটকের জন্ম দিল।আর সে নাটকের বলি হল,উসামা বিন লাদেন।এ বিন লাদেন কে সন্ত্রাসী হিসেবে প্রমাণ করতে শত শত ফিল্ম তৈরী করা হল।২০০০ সালের পর থেকে প্রায় সিনেমায় প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে লাদেন কে নিয়ে আলোচনা হয়েছে।লাদেনের কর্মকান্ডকে মিডিয়া,ফিল্ম,নাটক,ডকুমেন্টারীর মাধ্যমে উপস্থাপন করে গোটা মুসলিম উম্মাহ কে সন্ত্রাসী,মৌলবাদি,সেকেলে,একগুঁয়ে ও সংকীর্ণমনা হিসেবে চিত্রায়িত করা হয়েছে।অপরপক্ষে মুসলিমরা সে অনুপাতে ফিল্ম-নাটক তৈরী করে প্রচার করতে পারেনি যে,মুসলিমরা কখনো সন্ত্রাসী নয় এবং একজন মাত্র ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে বা অপ্রমাণিত অযুহাতের অভিযোগে কোনো দেশের ওপর আক্রমণ করে সেদেশের নারী,বৃদ্ধা ও শিশুদের হত্যা করাই হলো সন্ত্রাস।

আর এ কাজে ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ মুসলিম প্রযোজকদের সাপোর্ট না করায় তারা ইচ্ছা সত্ত্বেও ইসলামী ধ্যান-ধারণা সৃষ্টি করে এমন সিনেমা তৈরী করতে ভয় পায়।যদি ধর্ম বিরোধী ফতওয়ার স্বীকার হতে হয়! তবে তাদের সিনেমা ও নাটক তৈরীর কাজ থেমে থাকেনা।ফলে,তারা তৈরী করছে নগ্ন,অশ্লীল সিনেমা।হয় এদর না ওদর। আমরা একটু সূযোগ করে দিলে যে মেধা ও চিন্তা মানবতার কল্যাণে ব্যয় হতে পারত তা ব্যয় হয় পূঁজিবাদের লাইফ সাপোর্টারহিসেবে।

[০৪]

কম জনশক্তি দিয়ে বিশাল জনগোষ্ঠীকে শাষণ-শোষন করার একমাত্র মাধ্যম হলো মিডিয়া।আজকের বিশ্ব ব্যবস্থা মূলত এটিই প্রমাণ করে।একটি ছোট্ট পর্যবেক্ষণ আমাদেরকে এটি দ্রুত বুঝতে সহযোগীতা করবে।বিশ্বব্যাপী ইহুদী জনসংখ্যা প্রতি হাজারে ১০জন করে হলে ৭০০কোটি মানুষের ক্ষুদ্র একটি অংশ হলো ইহুদী।দু:খের কারণ হলেও সত্যি,তারা পৃথিবীর ৫০% ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে! কিভাবে?

এটি তাদের শত বছরের গবেষণা ও শ্রমের ফসল।১৮৯৭ সালের ২৯ ও ৩০ অগাস্ট সুইজারল্যান্ডেরবাজিল নগরীতে বিখ্যাত সাংবাদিক, চিন্তাবিদ ও দার্শনিক ড. থিওডর হার্টজাল ( Dr. Theodor Herzel) এর নেতৃত্বে ৩০০ বুদ্ধিজীবী সমবেত হন।কথিত যে,তৎকালীন বিশ্বের ৩০টি ইহুদী সংগঠনের সবচেয়ে বেশি মেধাবী ৩০০জন এতে অংশ গ্রহণ করে।তারা সেখানে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয় যে,দুনিয়াকে হাতে নিতে আমাদের দুইটি কাজ করতে হবে-

১.দুনিয়ার সকল স্বর্ণভান্ডার আয়ত্ব করতে হবে।অর্থ ব্যবস্থার জাল বিস্তার করে দুনিয়ার সকল পুঁজি কুক্ষিগত করতে হবে।

২.মিডিয়া আমাদের সে স্বপ্নকে বাস্তবায়নে দ্বিতীয় প্রধান ভূমিকা পালন করবে।এ লক্ষকে সামনে রেখে তারা সেখানে ১৯টি অধ্যায়ে পরিকল্পনাগুলো সাজাই। যা একজন খ্রীস্টান মহিলা চুরিকরে বিশ্ববাসীর সামনে প্রকাশ করে।যার দ্বাদশ অধ্যায়ের সার সংক্ষেপের কয়েকটি নিম্নরুপ:

১.আমারা আমাদের শত্রুদের হাতে এমন কোনো শক্তিশালি সংবাদ মাধ্যম থাকতে দেবনা,যার মাধ্যমে তাদের মতামত সমূহ কার্যকর পন্থায় প্রকাশ করতে পারে।আমরা এমন আইন-কানুন তৈরী করবো যাতে কেউ আমাদের অনুমতি ব্যতীত কিছু প্রকাশ করতে না পারে।তা'ছাড়া আমরা তাদের এমন কোনো সুযোগই দেব না যাতে,আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে কোনো সংবাদ সমাজের কাছে পৌছতে পারে।

২.আমরা যখন যাকে ইচ্ছা সমর্থন করবো। প্রয়োজনে জাতীর অনুভূতিকে উত্তজিত করে তুলব আবার প্রয়োজনে শান্ত করব।

৩.আমাদের মিডিয়া হবে ভারতের দেবতা বিষ্ণুর মত,যার শত শত হাত থাকবে।প্রয়োজন বোধে এমন পত্র-পত্রিকার পৃষ্ঠপোষকতা করবো যেগুলো বিচ্ছিন্নতা,পথভ্রষ্টতা,নৈতিক ও চারিত্রিক মূল্যবোধের অবক্ষয়,স্বৈরচারী ও একনায়কদের সমর্থন করে।

৪.আমরা এমন ব্যক্তিদের উৎসাহিত করবো যারা হবে লম্পট এবং তাদের অপরাদের রেকর্ড থাকবে।আমরা বিশ্বময় প্রচারের মাধ্যমে প্রয়োজনে তাদের হিরো বানাবো।

৫.আমরা পৃথিবীকে যে রঙ দেখাতে সিদ্ধান্ত নেবো পৃথিবীসে রঙ দেখতে পাবে।

৬.আমাদের শত্রুদের ধ্বংস করতে প্রথমে তাদের কে মানসিক ভাবে আঘাত করব তাতে কাজ না হলে শারীরিক ভাবে ধ্বংস করবো।

৭.প্রয়োজনবোধে আমরা সত্য ও মিথ্যা খবরাখবর এমনভাবে পরিবেশন করবো,যাতে জাতি ও সরকার সেগুলো গ্রহণ করে নিতে বাধ্য হয়।অবশ্য আমরা এ ব্যাপারে পূর্ণ সতর্কতা অবলম্বন করবো এবং পরিস্থিতি যথাযথ পরিক্ষা-নিরিক্ষকরেই পা ফেলবো।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যাদের কোনো দেশ ছিলনা তারা এ নীতি গ্রহণ করার পঞ্চাশ বছরের মধ্যে ১৯১৭ সালের ২রা নভেম্বর ঘোষিত বেলফোর ডিক্লারেশন বাস্তবায়নের মাধ্যমে (ইহুদীরা) ঈসরাইল নামক রাষ্ট্রের মালিক হয়।প্রথমে উল্লেখ করেছি তারা এটি গ্রহণ করেছে ১৮৯৭ সালে ঈসরাইল প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৪৮ সালে।

আমরা আমাদের শত্রুদের ঘৃণা তবে তাদের সম্পর্কে বেখবর হয়ে নয়।আমাদের শত্রুরা যখন আমাদের কে ধ্বংস করার জন্য ড্রোন নিয়ে হামলা করেন তখন আমাদের কাছে ড্রোন অপেক্ষা শক্তিশালি হাতিয়ার না থাকলেও ড্রোন হামলা প্রতিরোধ করার সামর্থ্য রাখতে হবে। তাই হাজার অস্ত্রের একটি 'মিডিয়া' সম্পর্কে তাদের ও আমাদের সামর্থ্য কেমন জেনে নেয়া যাক।

★ রায়টার্স: এটি একটি ইহুদী পরিচালিত বিশ্ববিখ্যাত সংবাদ সংস্থা। জুলিয়াস রায়টার এ সংবাদ সংস্থার মালিক।তিনি ১৮১৬ সালে জার্মানির এক ইহুদী পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন।পরে ১৮৫৭ সালে সে ব্রিটেনের নাগরিকত্ব পান। রায়টারের বিশ্বব্যাপী যত সদর দপ্তর আছে তার ৮০% কর্মচারী ইহুদী।

★এসোসিয়েটেড প্রেস: ১৮৪৮ যুক্তরাষ্ট্রের পাঁচটি বড়বড় দৈনিক পত্রিকা মিলে এটি প্রতিষ্ঠা করে।যার ৯০%মালিকানা ইহুদীদের।

★ইউনাইটেড প্রেস: ১৯০৭ সালে স্ক্রাইপস ও হাওয়ার্ড নামের দু'জন মার্কিন পূঁজিপতি এটি প্রতিষ্ঠা করেন।বর্তমানে এটি নিউইয়ির্ক টাইমসের মালিকানাধীন।

★এ.এফ.ফি: ফ্রান্সের ইহুদী পরিবার 'হাভস' এর প্রতিষ্ঠাতা।ফ্রান্সের ৮৫% পত্রিকার মালিক ইহুদী।অথচ ফ্রান্সে ইহুদী জনসংখ্যা মাত্র ১ কোটি।

★ লন্ডন টাইমস: শুরুতে এটি ইহুদীদের ছিল না।পরে অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত পূজিপতি রবার্ট মর্দোখ পত্রিকাটি ক্রয় করেন।এই ইহুদী পূঁজিপতি পঁয়তাল্লিশ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে পত্রিকাতি খরিদ করেন।টাকার হিসেবে শুধু পাঁচশ কোটি টাকার কাছাকাছি!

★ সানডে টাইমস: 'লন্ডন টাইমসে'র মালিক রবার্ট মর্দোখ। সাপ্তাহিক সান,নিউজ অব দি ওয়ার্ল্ড,সিটি ম্যাগাজিন তারই মালিকানাধীন। সান পত্রিকার সাপ্তাহিক প্রচার সংখ্যা ৩৮ লাখ!তা'ছাড়া ডেইলী এক্সপ্রেস,নিউজ ক্রনিকেল,ডেইলী মেইল, ডেইলী রোড গার্ডিয়ান,ইভিনইং নিউজ,অবজারভার,সানডে রেডিও,সানডে এক্সপ্রেস,দি সানডে পিপলস সহ আরো অনেক পত্রিকা ইহুদীদের মালিকানায় প্রকাশ হয়।১৯৮১ সালের এক জরিপে দেখা যায়,ব্রিটেনের ১ম থেকে ১৫ তম শীর্ষ দৈনিকগুলোর মালিক ইহুদী।

★বিবিসি: মালেশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ড মাহাথির মাহমুদের ভাষায় বিশ্ববেঈমান হলো বিবিসি।যার প্রচার প্রসারে ইহুদীদের পৃষ্ঠপোষকতা সর্বজনগ্রাহ্য।

এ হলো কয়েকটি বিখ্যাত মিডিয়া যা বিশ্বব্যাপী ইহুদিবাদপ্রচার-প্রতিষ্ঠার দায়িত্বেরত।এ ছাড়াও আছে নাটক-ফিল্ম।যে চ্যানেলগুলো দিবা-রাত্রি তাদের অনুষ্ঠান প্রচারের মধ্যমে বিশ্বব্যাপী নগ্নতা,অশ্লীলতা,অপরাধ প্রবণতা,পারিবারিক ভাঙ্গন সৃষ্টি করছে।১৯২৯ সালে মোশন পিকচার্স রিচার্স কাউন্সিলের নির্বাহী পরিচালকের আহ্বানে ১৯৩২ সালে পর্যন্ত তিন বছর সময়ব্যাপী একটি জরিপ চালানো হয়।এতে প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ এডার ডেল ১৫শ ছবি নিয়ে গবেষণা করে দেখতে পান যে, ১০টি বিষয় নিয়ে সাধারণত ছবি নির্মিত হয়েছে। তা হলো-অপরাধ,যৌনতা,প্রেম,রহস্য,যুদ্ধ,শৈশব,ইতিহাস,ভ্রমণ,কমেডি ও সামাজিক প্রোপাগান্ডা।তিনি আরও দেখতে পান যে,১৫শ ছবির প্রায় ১১শ ছবি যৌনতা,অপরাধ ও প্রেম নিয়ে!আজ বুদ্ধিজীবি,শিক্ষাবিদ তথা পরিচ্ছন্ন মনের অধিকারী ব্যক্তি মাত্রাই যে ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে শঙ্কাকরে তা হলো 'পর্নোগ্রফি'।যাথেকে কেউ মুক্ত নয়,প্রজন্ম বড়ই ধ্বংসের দারপ্রান্তে।আর এর নির্ভেজাল আবিষ্কারক হল-ইহুদী।এ থেকে যদি বাচার বিকল্প পথ না খোঁজি তবে আমরা আগামীর যে সুন্দর স্বপ্ন দেখছি তা স্বপ্নই থেকে যাবে।

ইহুদী-খ্রীস্টানদের মাঝে ধর্মীয় ও আদর্শগতভাবে চরম বিরোধ থাকা সত্ত্বেও মুসলিম নিধনে তারা ঐক্যবদ্ধ।তারা এমনভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে যে,খ্রীস্টান মিশনারীগুলোতেও ইহুদী ধর্ম প্রচার হয়।মুসলিম নিধনে অমুসলিমরা ধর্মীয় বিভেদ ভুলে এক হতে পারে কিন্তু মুসলিমরা 'শীতকালে ঠান্ড পানি' দিয়ে অযূ জায়েজ বা নাজায়েজ শীর্ষক তর্ক-বিতর্কে মারামারিকরে।যা বড় আফসোসের বিষয়।এ প্রসঙ্গে আল্লামা ইকবালেরএকটি উক্তি স্মরণীয়:

"লাভ-লোকসান এক তোমাদের,এক মঞ্জীল,এক মোকাম,

এক তোমাদের নবী-রাসূল,এক তোমাদের দ্বীন ইসলাম।

এক তোমাদের আল্লাহ এক তোমাদের আল- কুরআন,

আফসোস, হায়, তবুও তোমরা এক নহে মুসলমান!

তোমাদের মাঝে হাজার ফিরকা,হাজার দল ও হাজার মত,

এমন জাতি কি দুনিয়ার বুকে খুঁজে পায় মুক্তির পথ!"

বিষয়: বিবিধ

১৬৩৫ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

353575
১২ ডিসেম্বর ২০১৫ রাত ০১:৪০
মুিনর লিখেছেন : ধন্যবাদ খুবই সংক্ষেপে ইসলামের মৌলিক বিষয় গুলো অনেক সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে তুলে ধরেছেন।
353627
১২ ডিসেম্বর ২০১৫ সকাল ১১:১৬
Saidul Karim লিখেছেন : আশা করি আগামীতেও পাশে থেকে প্রেরণা,পরামর্শ দেবেন।
ধন্যবাদ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File